ছোট একটা শহরের প্রাথমিক স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর এক শিক্ষিকা, যাঁর অভ্যাস ছিল তিনি ক্লাস শুরু হওয়ার আগে রোজ “আই লাভ ইউ অল্” বলতেন। কিন্তু তিনি জানতেন, তিনি সত্য বলছেননা। তিনি জানতেন ক্লাসের সবাইকে একরকমভাবে তিনি ভালবাসেন না।
ক্লাসের রাজু নামে একটা বাচ্চা যাকে তিনি মোটেও সহ্য করতে পারতেননা। রাজু ময়লা জামাকাপড়ে স্কুলে আসত, তার চুলগুলো থাকত উষ্কো-খুষ্কো, জুতোর বকলস্ খোলা, শার্টের কলারে ময়লা দাগ ….ক্লাসে পড়া বোঝানোর সময়ও সে ছিল খুব অন্যমনস্ক। মিসের বকুনি খেয়ে সে চমকে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকত। কিন্তু তার শূন্য দৃষ্টি দেখে স্পষ্ট বোঝা যেত যে রাজু শারীরিকভাবে ক্লাসে উপস্থিত থাকলেও তার মন অন্য কোনখানে উধাও হয়ে গেছে, ধীরে ধীরে রাজুর প্রতি মিসের মনে ঘৃণার উদ্রেক হলো l ক্লাসে ঢুকতেই রাজু মিসের সমালোচনার শিকার হয়ে যেত l সবরকম খারাপ কাজের উদাহরণ রাজুর নামে হতে থাকল। বাচ্চারা তাকে দেখে আর খিলখিল করে হাসে, মিসও তাকে অপমান করে সন্তোষ লাভ করেন।
রাজু যদিও এইসব কথার কোনও উত্তর দিতনা। মিসের তাকে নিষ্প্রাণ পাথর বলে মনে হতো যার মধ্যে অনুভূতি নামে কোন জিনিস ছিলনা। সমস্ত ধমক, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ আর শাস্তির জবাবে সে শুধু নিজের ভাবনায় শূন্য দৃষ্টিতে তাঁকে দেখত আর মাথা নীচু করে নিত। এইভাবে সে মিসের অত্যন্ত বিরাগভাজন হয়ে উঠলো। প্রথম সেমেস্টার শেষ হয়ে রিপোর্ট বেরোনোর সময় হলে মিস প্রগতি পত্রে (রেজাল্ট কার্ড) তার সম্পর্কে সব খারাপ কথা লিখে দিলেন। মা -বাবাকে দেখানোর আগে প্রগতি পত্র হেড মিস্ট্রেসের কাছে পাঠাতে হতো। তিনি রাজুর রিপোর্ট দেখে মিসকে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন, “মিস ! প্রগতি পত্রে কিছু তো প্রগতির কথা লেখা উচিত্ ! আপনি তো যা কিছু লিখেছেন তার থেকে রাজুর বাবা একদম নিরাশ হয়ে যাবেন।” মিস বললেন, “আমি মাফ চাইছি, কিন্তু রাজু এক অশিষ্ট আর নিষ্কর্মা বাচ্চা। আমার মনে হয়না আমি ওর উন্নতির সম্পর্কে কিছু লিখতে পারি !” মিস ঘৃণার সাথে এই কথা বলে সেখান থেকে উঠে এলেন।
হেড মিস্ট্রেস অদ্ভুত একটা ব্যাপার করলেন। তিনি চাপরাশির হাত দিয়ে মিসের ডেস্কের ওপরে রাজুর আগের বছরের প্রগতি পত্র রাখিয়ে দিলেন । পরের দিন যখন মিস ক্লাসে ঢুকলেন তখন রিপোর্টের ওপরে নজর পড়তে, উল্টে দেখেন সেটা রাজুরই প্রগতি পত্র ! ভাবলেন আগের বছরও নিশ্চয়ই সে এইরকম আচরণ করেছে…
ভাবার সাথে সাথেই তৃতীয় শ্রেণীর রিপোর্টটা খোলেন। রিপোর্টের মন্তব্য পড়ে ওনার আশ্চর্যের সীমা রইলনা, রাজুর উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় রিপোর্ট কার্ডটি ভরা – তাতে লেখা আছে, “রাজুর মতো বুদ্ধিমান বাচ্চা আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি। অতি সংবেদনশীল বাচ্চা এবং নিজের সহপাঠী আর শিক্ষকের প্রতি সম্মান এবং সহযোগিতা করে।” অন্তিম সেমেস্টারেও রাজু প্রথম স্থান আধিকার করে নেয়। অস্থিরভাবে মিস চতুর্থ শ্রেণীর রিপোর্ট খোলেন, সেখানে লেখা আছে “রাজুর লেখাপড়ার ওপর তার মায়ের অসুখের গভীর প্রভাব পড়ছে, পড়াশোনার প্রতি অমনোযোগী হয়ে উঠছে।” রাজুর মা মারা গেছে এবং সঙ্গে রাজুর জীবনের যাবতীয় আশা ভরসা আর সুন্দর ভবিষ্যতের আলোও l তাকে বাঁচাতে হবে …..আরও দেরী হয়ে যাওয়ার আগে। মিসের মাথায় যেন অত্যন্ত ভারী বোঝা চেপে আছে ….কাঁপা হাতে তিনি রিপোর্ট বন্ধ করেন। তার নয়ন অশ্রুসজল হয়ে উঠলো ….টপ টপ করে চোখের জল ঝরতে লাগলো।
পরের দিন যখন ক্লাসে ঢুকলেন তাঁর নিজের চির অভ্যস্ত বাক্যের পুনরাবৃত্তি করলেন, “আই লাভ ইউ অল্” কিন্তু বুঝতে পারছিলেন আজও তিনি সত্যের অপলাপ করছেন। কারণ এলোমেলো চুলে এই ক্লাসে বসে থাকা বাচ্চাটা, রাজুর প্রতি যে স্নেহ তিনি হৃদয়ে অনুভব করছিলেন ….তা’ ক্লাসের অন্য বাচ্চাদের জন্য হওয়া সম্ভবই ছিলনা। পড়া বোঝানোর সময় রোজের দিনচর্যার মতো রাজুর দিকে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন আর রাজুও রোজের মতো মাথা নীচু করে নিলো। যখন বেশ কিছুক্ষণ পর্যন্ত মিসের ধমক বা শ্লেষাত্মক কথার কোনটাই বা সহপাঠীদের সম্মিলিত হাসির শব্দ কানে এলোনা তখন সে আচমকা মাথা উঁচু করে তাঁর দিকে চেয়ে রইলো l অপ্রত্যাশিতভাবে তার মাথা আজ মুন্ডিত, কেশহীন ছিল।
তাঁর মুখে মৃদু হাসি। তিনি রাজুকে কাছে ডাকলেন এবং প্রশ্নের উত্তর বলে দিয়ে তা’ আওড়াতে বললেন। রাজু তিন-চারবার চেষ্টার পর অবশেষে বলতে পারলো। তার জবাব দেওয়ার সাথে সাথে মিস খুশি হয়ে শুধু নিজে তালি দিলেন না, বরং অন্য সব বাচ্চাদের দিয়েও দেওয়ালেন। তারপরে এটা প্রত্যেক দিনের দিনচর্যা হয়ে গেল। মিস সব উত্তর নিজের থেকে দিতেন, তারপর সস্নেহে রাজুকে বাহবা দিতেন। সব ভালো কাজের উদাহরণে রাজুর নাম বলা হতে লাগলো। ধীরে ধীরে বিষণ্ণতার কবর ফুঁড়ে রাজু বেরিয়ে আসলো। এখন থেকে আর মিসকে প্রশ্নের সাথে উত্তর বলে বলে দেওয়ার প্রয়োজন হতোনা। সে রোজ সঠিক উত্তর দিয়ে সবাইকে প্রভাবিত করতো এবং নতুন নতুন প্রশ্ন করে হয়রানও।
তার চুলগুলো এখন অনেকটা পরিপাটি থাকত, জামাকাপড়ও যথেষ্ট পরিষ্কার থাকতো, হয়তো সে নিজেই কাচতে শুরু করেছিল। দেখতে দেখতে বছর শেষ হয়ে গেল, রাজু দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণ হলো।
বিদায়কালীন সমারোহে সব বাচ্চারা মিসের জন্য সুন্দর সুন্দর উপহার নিয়ে এলো আর মিসের টেবিলের ওপর একের পর এক পাহাড় জমে গেল। এত সুন্দরভাবে প্যাক করা উপহারের মধ্যে পুরানো কাগজে অগোছালোভাবে মোড়া একটা উপহার পড়েছিলো। বাচ্চারা তাই দেখে হাসতে লাগলো। কারও জানতে বাকি রইলো না যে উপহার হিসেবে সেটা রাজুই এনেছে। মিস উপহারের এই ছোট পাহাড় থেকে সেটা বার করে আনলেন। খুলে দেখলেন তার ভিতরে মহিলাদের আতরের অর্ধেক ব্যবহার করা একটা শিশি আর এক হাতে পরার মতো বড় একটা বালা যার বেশিরভাগ মোতি ঝরে গিয়েছিলো। মিস চুপচাপ শিশি থেকে নিজের গায়ে আতর ছিটিয়ে দিলেন এবং বালাটা হাতে পরে নিলেন। বাচ্চারা এই দৃশ্য দেখে খুব অবাক হয়ে যায়। রাজু নিজেও… শেষ পর্যন্ত রাজু থাকতে না পেরে মিসের কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল।
কিছুক্ষণ পর সে থমকে থমকে মিসকে বলল, “আজ আপনার গা’ থেকে আমার মায়ের মতো গন্ধ আসছে।
সময় পাখা মেলে উড়তে লাগলো l দিন সপ্তাহে, সপ্তাহ মাসে আর মাস বছরে বদলাতে আর কোথায় সময় লাগে ? কিন্তু প্রত্যেক বছরের শেষে রাজুর কাছ থেকে একটা চিঠি নিয়মিতভাবে আসতো যাতে লেখা থাকতো, “এই বছর অনেক নতুন টিচারের সংস্পর্শে এসেছি কিন্তু আপনার মতো কেউ ছিলনা।” তারপর রাজুর স্কুলপর্ব শেষ হয়ে গেল এবং চিঠির ধরাবাহিকতাও। কয়েক বছর পর মিসেরও রিটায়ার হয়ে গেল। একদিন তাঁর নিজের মেলে রাজুর চিঠি পেলেন যাতে লেখা ছিলো, “এই মাসের শেষে আমার বিয়ে, আপনাকে ছাড়া বিয়ের কথা ভাবতে পারিনা, আরেকটা কথা …..জীবনে আমি অনেক লোকের সাথে মিশেছি, আপনার মতো কেউ নেই …ডক্টর রাজু
সাথে প্লেনে যাওয়া আসার টিকিটও খামের মধ্যে ছিলো। মিস নিজেকে কিছুতেই আটকে রাখতে পারছিলেন না। তিনি স্বামীর থেকে অনুমতি নিয়ে অন্য শহরে যাওয়ার জন্য রওনা দিলেন। বিয়ের দিনে যখন বিয়ের আসরে উপস্থিত হলেন তখন খানিকটা দেরী হয়ে গেছিলো। তাঁর মনে হয়েছিল বিয়ের অনুষ্ঠান নিশ্চয়ই শেষ হয়ে গেছে…..কিন্তু এটা দেখে তাঁর আশ্চর্য হওয়ার সীমা ছিলনা ; শহরের বড় বড় ডাক্তার, বিজনেসম্যান, এমনকি বিয়ে দেবেন যিনি সেই পণ্ডিতজীও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন যে এখনও কার আসা বাকি আছে ….কিন্তু রাজু বিয়ের অনুষ্ঠানের মণ্ডপের বদলে গেটের দিকে চোখ লাগিয়ে তাঁর আসার অপেক্ষা করছিলো। তারপর সবাই দেখে ছোটবেলার এই টিচার গেটের ভিতরে ঢুকতেই রাজু তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাত ধরেছে যে হাতে তিনি এখনও সেই খারাপ হয়ে যাওয়া বালাটা পরেছিলেন ; তাঁকে সসম্মানে মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হলো। মাইক হাতে নিয়ে সে এইরকম কিছু বলল, “বন্ধুরা ! আপনারা সবাই সবসময় আমাকে আমার মায়ের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন আর আমি আপনাদের সবার কাছে প্রতিজ্ঞা করতাম যে খুব শিগগির আপনাদের সবাইকে তাঁর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো
……ইনি আমার মা – ———-”
প্রিয় পাঠক, এই সুন্দর কাহিনী শুধু শিক্ষক -ছাত্রের সম্পর্কের কথা ভাববেন না। নিজেদের আশেপাশে দেখুন, রাজুর মতো কোনও ফুল ম্রিয়মাণ থাকলে আপনার একটু মনোযোগ, ভালবাসা আর স্নেহ নতুন জীবন দিতে পারে । ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভূলবেন না …
সূত্র: গল্পওয়ালা ডটকম
ক্লাসের রাজু নামে একটা বাচ্চা যাকে তিনি মোটেও সহ্য করতে পারতেননা। রাজু ময়লা জামাকাপড়ে স্কুলে আসত, তার চুলগুলো থাকত উষ্কো-খুষ্কো, জুতোর বকলস্ খোলা, শার্টের কলারে ময়লা দাগ ….ক্লাসে পড়া বোঝানোর সময়ও সে ছিল খুব অন্যমনস্ক। মিসের বকুনি খেয়ে সে চমকে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকত। কিন্তু তার শূন্য দৃষ্টি দেখে স্পষ্ট বোঝা যেত যে রাজু শারীরিকভাবে ক্লাসে উপস্থিত থাকলেও তার মন অন্য কোনখানে উধাও হয়ে গেছে, ধীরে ধীরে রাজুর প্রতি মিসের মনে ঘৃণার উদ্রেক হলো l ক্লাসে ঢুকতেই রাজু মিসের সমালোচনার শিকার হয়ে যেত l সবরকম খারাপ কাজের উদাহরণ রাজুর নামে হতে থাকল। বাচ্চারা তাকে দেখে আর খিলখিল করে হাসে, মিসও তাকে অপমান করে সন্তোষ লাভ করেন।
রাজু যদিও এইসব কথার কোনও উত্তর দিতনা। মিসের তাকে নিষ্প্রাণ পাথর বলে মনে হতো যার মধ্যে অনুভূতি নামে কোন জিনিস ছিলনা। সমস্ত ধমক, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ আর শাস্তির জবাবে সে শুধু নিজের ভাবনায় শূন্য দৃষ্টিতে তাঁকে দেখত আর মাথা নীচু করে নিত। এইভাবে সে মিসের অত্যন্ত বিরাগভাজন হয়ে উঠলো। প্রথম সেমেস্টার শেষ হয়ে রিপোর্ট বেরোনোর সময় হলে মিস প্রগতি পত্রে (রেজাল্ট কার্ড) তার সম্পর্কে সব খারাপ কথা লিখে দিলেন। মা -বাবাকে দেখানোর আগে প্রগতি পত্র হেড মিস্ট্রেসের কাছে পাঠাতে হতো। তিনি রাজুর রিপোর্ট দেখে মিসকে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন, “মিস ! প্রগতি পত্রে কিছু তো প্রগতির কথা লেখা উচিত্ ! আপনি তো যা কিছু লিখেছেন তার থেকে রাজুর বাবা একদম নিরাশ হয়ে যাবেন।” মিস বললেন, “আমি মাফ চাইছি, কিন্তু রাজু এক অশিষ্ট আর নিষ্কর্মা বাচ্চা। আমার মনে হয়না আমি ওর উন্নতির সম্পর্কে কিছু লিখতে পারি !” মিস ঘৃণার সাথে এই কথা বলে সেখান থেকে উঠে এলেন।
হেড মিস্ট্রেস অদ্ভুত একটা ব্যাপার করলেন। তিনি চাপরাশির হাত দিয়ে মিসের ডেস্কের ওপরে রাজুর আগের বছরের প্রগতি পত্র রাখিয়ে দিলেন । পরের দিন যখন মিস ক্লাসে ঢুকলেন তখন রিপোর্টের ওপরে নজর পড়তে, উল্টে দেখেন সেটা রাজুরই প্রগতি পত্র ! ভাবলেন আগের বছরও নিশ্চয়ই সে এইরকম আচরণ করেছে…
ভাবার সাথে সাথেই তৃতীয় শ্রেণীর রিপোর্টটা খোলেন। রিপোর্টের মন্তব্য পড়ে ওনার আশ্চর্যের সীমা রইলনা, রাজুর উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় রিপোর্ট কার্ডটি ভরা – তাতে লেখা আছে, “রাজুর মতো বুদ্ধিমান বাচ্চা আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি। অতি সংবেদনশীল বাচ্চা এবং নিজের সহপাঠী আর শিক্ষকের প্রতি সম্মান এবং সহযোগিতা করে।” অন্তিম সেমেস্টারেও রাজু প্রথম স্থান আধিকার করে নেয়। অস্থিরভাবে মিস চতুর্থ শ্রেণীর রিপোর্ট খোলেন, সেখানে লেখা আছে “রাজুর লেখাপড়ার ওপর তার মায়ের অসুখের গভীর প্রভাব পড়ছে, পড়াশোনার প্রতি অমনোযোগী হয়ে উঠছে।” রাজুর মা মারা গেছে এবং সঙ্গে রাজুর জীবনের যাবতীয় আশা ভরসা আর সুন্দর ভবিষ্যতের আলোও l তাকে বাঁচাতে হবে …..আরও দেরী হয়ে যাওয়ার আগে। মিসের মাথায় যেন অত্যন্ত ভারী বোঝা চেপে আছে ….কাঁপা হাতে তিনি রিপোর্ট বন্ধ করেন। তার নয়ন অশ্রুসজল হয়ে উঠলো ….টপ টপ করে চোখের জল ঝরতে লাগলো।
পরের দিন যখন ক্লাসে ঢুকলেন তাঁর নিজের চির অভ্যস্ত বাক্যের পুনরাবৃত্তি করলেন, “আই লাভ ইউ অল্” কিন্তু বুঝতে পারছিলেন আজও তিনি সত্যের অপলাপ করছেন। কারণ এলোমেলো চুলে এই ক্লাসে বসে থাকা বাচ্চাটা, রাজুর প্রতি যে স্নেহ তিনি হৃদয়ে অনুভব করছিলেন ….তা’ ক্লাসের অন্য বাচ্চাদের জন্য হওয়া সম্ভবই ছিলনা। পড়া বোঝানোর সময় রোজের দিনচর্যার মতো রাজুর দিকে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন আর রাজুও রোজের মতো মাথা নীচু করে নিলো। যখন বেশ কিছুক্ষণ পর্যন্ত মিসের ধমক বা শ্লেষাত্মক কথার কোনটাই বা সহপাঠীদের সম্মিলিত হাসির শব্দ কানে এলোনা তখন সে আচমকা মাথা উঁচু করে তাঁর দিকে চেয়ে রইলো l অপ্রত্যাশিতভাবে তার মাথা আজ মুন্ডিত, কেশহীন ছিল।
তাঁর মুখে মৃদু হাসি। তিনি রাজুকে কাছে ডাকলেন এবং প্রশ্নের উত্তর বলে দিয়ে তা’ আওড়াতে বললেন। রাজু তিন-চারবার চেষ্টার পর অবশেষে বলতে পারলো। তার জবাব দেওয়ার সাথে সাথে মিস খুশি হয়ে শুধু নিজে তালি দিলেন না, বরং অন্য সব বাচ্চাদের দিয়েও দেওয়ালেন। তারপরে এটা প্রত্যেক দিনের দিনচর্যা হয়ে গেল। মিস সব উত্তর নিজের থেকে দিতেন, তারপর সস্নেহে রাজুকে বাহবা দিতেন। সব ভালো কাজের উদাহরণে রাজুর নাম বলা হতে লাগলো। ধীরে ধীরে বিষণ্ণতার কবর ফুঁড়ে রাজু বেরিয়ে আসলো। এখন থেকে আর মিসকে প্রশ্নের সাথে উত্তর বলে বলে দেওয়ার প্রয়োজন হতোনা। সে রোজ সঠিক উত্তর দিয়ে সবাইকে প্রভাবিত করতো এবং নতুন নতুন প্রশ্ন করে হয়রানও।
তার চুলগুলো এখন অনেকটা পরিপাটি থাকত, জামাকাপড়ও যথেষ্ট পরিষ্কার থাকতো, হয়তো সে নিজেই কাচতে শুরু করেছিল। দেখতে দেখতে বছর শেষ হয়ে গেল, রাজু দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণ হলো।
বিদায়কালীন সমারোহে সব বাচ্চারা মিসের জন্য সুন্দর সুন্দর উপহার নিয়ে এলো আর মিসের টেবিলের ওপর একের পর এক পাহাড় জমে গেল। এত সুন্দরভাবে প্যাক করা উপহারের মধ্যে পুরানো কাগজে অগোছালোভাবে মোড়া একটা উপহার পড়েছিলো। বাচ্চারা তাই দেখে হাসতে লাগলো। কারও জানতে বাকি রইলো না যে উপহার হিসেবে সেটা রাজুই এনেছে। মিস উপহারের এই ছোট পাহাড় থেকে সেটা বার করে আনলেন। খুলে দেখলেন তার ভিতরে মহিলাদের আতরের অর্ধেক ব্যবহার করা একটা শিশি আর এক হাতে পরার মতো বড় একটা বালা যার বেশিরভাগ মোতি ঝরে গিয়েছিলো। মিস চুপচাপ শিশি থেকে নিজের গায়ে আতর ছিটিয়ে দিলেন এবং বালাটা হাতে পরে নিলেন। বাচ্চারা এই দৃশ্য দেখে খুব অবাক হয়ে যায়। রাজু নিজেও… শেষ পর্যন্ত রাজু থাকতে না পেরে মিসের কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল।
কিছুক্ষণ পর সে থমকে থমকে মিসকে বলল, “আজ আপনার গা’ থেকে আমার মায়ের মতো গন্ধ আসছে।
সময় পাখা মেলে উড়তে লাগলো l দিন সপ্তাহে, সপ্তাহ মাসে আর মাস বছরে বদলাতে আর কোথায় সময় লাগে ? কিন্তু প্রত্যেক বছরের শেষে রাজুর কাছ থেকে একটা চিঠি নিয়মিতভাবে আসতো যাতে লেখা থাকতো, “এই বছর অনেক নতুন টিচারের সংস্পর্শে এসেছি কিন্তু আপনার মতো কেউ ছিলনা।” তারপর রাজুর স্কুলপর্ব শেষ হয়ে গেল এবং চিঠির ধরাবাহিকতাও। কয়েক বছর পর মিসেরও রিটায়ার হয়ে গেল। একদিন তাঁর নিজের মেলে রাজুর চিঠি পেলেন যাতে লেখা ছিলো, “এই মাসের শেষে আমার বিয়ে, আপনাকে ছাড়া বিয়ের কথা ভাবতে পারিনা, আরেকটা কথা …..জীবনে আমি অনেক লোকের সাথে মিশেছি, আপনার মতো কেউ নেই …ডক্টর রাজু
সাথে প্লেনে যাওয়া আসার টিকিটও খামের মধ্যে ছিলো। মিস নিজেকে কিছুতেই আটকে রাখতে পারছিলেন না। তিনি স্বামীর থেকে অনুমতি নিয়ে অন্য শহরে যাওয়ার জন্য রওনা দিলেন। বিয়ের দিনে যখন বিয়ের আসরে উপস্থিত হলেন তখন খানিকটা দেরী হয়ে গেছিলো। তাঁর মনে হয়েছিল বিয়ের অনুষ্ঠান নিশ্চয়ই শেষ হয়ে গেছে…..কিন্তু এটা দেখে তাঁর আশ্চর্য হওয়ার সীমা ছিলনা ; শহরের বড় বড় ডাক্তার, বিজনেসম্যান, এমনকি বিয়ে দেবেন যিনি সেই পণ্ডিতজীও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন যে এখনও কার আসা বাকি আছে ….কিন্তু রাজু বিয়ের অনুষ্ঠানের মণ্ডপের বদলে গেটের দিকে চোখ লাগিয়ে তাঁর আসার অপেক্ষা করছিলো। তারপর সবাই দেখে ছোটবেলার এই টিচার গেটের ভিতরে ঢুকতেই রাজু তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাত ধরেছে যে হাতে তিনি এখনও সেই খারাপ হয়ে যাওয়া বালাটা পরেছিলেন ; তাঁকে সসম্মানে মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হলো। মাইক হাতে নিয়ে সে এইরকম কিছু বলল, “বন্ধুরা ! আপনারা সবাই সবসময় আমাকে আমার মায়ের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন আর আমি আপনাদের সবার কাছে প্রতিজ্ঞা করতাম যে খুব শিগগির আপনাদের সবাইকে তাঁর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো
……ইনি আমার মা – ———-”
প্রিয় পাঠক, এই সুন্দর কাহিনী শুধু শিক্ষক -ছাত্রের সম্পর্কের কথা ভাববেন না। নিজেদের আশেপাশে দেখুন, রাজুর মতো কোনও ফুল ম্রিয়মাণ থাকলে আপনার একটু মনোযোগ, ভালবাসা আর স্নেহ নতুন জীবন দিতে পারে । ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভূলবেন না …
সূত্র: গল্পওয়ালা ডটকম
Comments
Post a Comment